কোন নেতা বা আমিরের আনুগত্য করা কি ওয়াজিব

সকল প্রশংসা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের, দরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক মুহাম্মদ সাঃ এর প্রতি। আজকের আলোচ্যবিষয় কোন নেতা বা আমিরের আনুগত্য করা কি ওয়াজিব, যেমনি ভাবে আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করা ওয়াজিব? এ ব্যাপারে সবচেয়ে পরিচিত আয়াতটি হচ্ছে-

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَطِیۡعُوا اللّٰهَ وَ اَطِیۡعُوا الرَّسُوۡلَ وَ اُولِی الۡاَمۡرِ مِنۡکُمۡ

হে মুমিনগণ, তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর ও আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্য থেকে কর্তৃত্বের অধিকারীদের। (সুরা নিসা, আয়াতঃ ৫৯)

এই আয়াতের পরবর্তি অংশটি হলো –

فَاِنۡ تَنَازَعۡتُمۡ فِیۡ شَیۡءٍ فَرُدُّوۡهُ اِلَی اللّٰهِ وَ الرَّسُوۡلِ اِنۡ کُنۡتُمۡ تُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰهِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ ؕ ذٰلِکَ خَیۡرٌ وَّ اَحۡسَنُ تَاۡوِیۡلًا

অতঃপর কোন বিষয়ে যদি তোমরা মতবিরোধ কর তাহলে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে প্রত্যার্পণ করাও- যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখ। এটি উত্তম এবং পরিণামে উৎকৃষ্টতর। (সুরা নিসা, আয়াতঃ ৫৯)

উপরোক্ত আয়াত থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় আল্লাহ ও তার রাসূল (মুহাম্মদ সাঃ) এর আনুগত্য করা ওয়াজিব, কিন্তু নেতার আনুগ্যতা সরাসরি ওয়াজিব কিনা এ ব্যাপারটি পুরোপুরি পরিষ্কার নয় কারন, أَطِيْعُوا الله   أَطِيْعُوا الرَّسُوْل  বলা হলেও এখানে وَأَطِيْعُوا أُولِي الأَمْر  বলা হয়নি।

এই বিষয়টি নিয়ে আরো কথা বলার পূর্বে আসুন দেখে নেই, الأمر  (উলুল আম্র) বলতে তাফসিরে কাদেরকে বুঝানো হয়েছে, উলুল আম্র বলতে কেউ বলেছেন, নেতা ও শাসকগণ। কেউ বলেছেন, উলামা ও ফুক্বাহাগণ। অর্থের দিক দিয়ে উভয় শ্রেণীর মান্যবরদেরকেই বুঝানো যেতে পারে। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা, মুজাহিদ ও হাসান বসরী রাহিমাহুমাল্লাহ প্রমূখ মুফাসসিরগণ ওলামা ও ফোকাহা সম্প্রদায়কে ‘উলুল আমর’ সাব্যস্ত করেছেন। তারাই হচ্ছেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নায়েব বা প্রতিনিধি ৷ তাদের হাতেই দ্বীনী ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্পিত। মুফাসসিরীনের অপর এক জামা'আত-যাদের মধ্যে আবু হোরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রমূখ সাহাবায়ে কেরামও রয়েছেন-বলেছেন যে, ‘উলুল আমর’ এর অর্থ হচ্ছে সে সমস্ত লোক, যাদের হাতে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত। ইমাম সুদ্দী এ মত পোষণ করেন। এছাড়া তাফসীরে ইবন কাসীরে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ শব্দটির দ্বারা ওলামা ও শাসক উভয় শ্রেণীকেই বোঝায়। কারণ, নির্দেশ দানের বিষয়টি তাদের উভয়ের সাথেই সম্পর্কিত। আল্লামা আবু বকর জাসসাস এতদুভয় মত উদ্ধৃত করার পর বলেছেন, সঠিক ব্যাপার হলো এই যে, এতদুভয় অর্থই ঠিক। কারণ, ‘উলুল আমর’ শব্দটি উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

তবে উলুল আমর যিনিই হোন না কেন, আয়াতের ভাষ্য ও তাফসীর বিদদের মত অনুযায়ী নেতার বা কর্তৃত্বের অধিকারীদের আনুগত্য করাও ওয়াজিব, তবে এ আনুগত্য আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্যের মত নিঃস্বার্থ নয় বরং কিছু শর্ত সাপেক্ষে।

কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন, أَلاَ لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ ‘‘জেনে রাখো, সৃষ্টি করা এবং নির্দেশদান তাঁরই কাজ।’’ (আ’রাফঃ ৫৪) এছাড়ও তিনি বলেন, اِنِ الْحُكْمُ إلاَّ للهِ ‘‘বিধান দেওয়ার অধিকার শুধু আল্লাহরই।’’ (ইউসুফঃ ৪০)। আল্লাহ তাআলা অপর এক আয়াতে রাসূল সাঃ এর আনুগত্যের ব্যাপারে বলেন, مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهَ  ‘‘যে ব্যক্তি রসূলের আনুগত্য করল, সে আল্লাহর আনুগত্য করল।’’ (নিসাঃ ৮০) উপরোক্ত আয়াত দিয়ে এটা পরিষ্কার হয় যে আল্লাহ ও তার রাসূলের দ্বিধাহীন আনুগত্য করা ওয়াজিব।

এভাবে আল্লাহ ও রাসূল সাঃ সম্পর্কে বলা হলেও কিন্তু উলুল আমর সম্পর্কে বলা হয়নি বরং হাদিসে বলা হয়েছে,  لا طَاعَةَ لِمَخْلُوْقٍ فِي مَعْصِيَةِ الخَالِقِ ‘‘আল্লাহর অবাধ্যাচরণে কোন সৃষ্টির আনুগত্য নেই।’’ (মিশকাত ৩৬৯৬, আল্লামা আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।) মুসলিম শরীফের বর্ণনায় এসেছে, ‘‘আল্লাহর অবাধ্যতায় কোন আনুগত্য নেই।’’ (মুসলিম ১৮৪০নং)

বরং উলুল আমর এর আনুগত্যের ব্যাপারে বুখারীর বর্ণনায় এসেছে, إِنَّمَا الطَّاعَةُ فِي المَعْرُوْفِ ‘‘আনুগত্য হবে কেবল ভালো কাজে।’’ (বুখারী ৭১৪৫) সুতরাং এখান থেকে এই বিষয়টি স্পষ্ট হলো যে, যদি কেউ আল্লাহর বিধান ও রাসূল সাঃ এর দেখানো পথ অনুযায়ী নির্দেশনা দেয় যা, আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নির্দেশের বাস্তবায়ন করে অথবা সকল মানুষের কল্যাণ সাধনের ব্যবস্থাপনা ও তার রক্ষণাবেক্ষণ করে, তবে তার আনুগত্য করাও ওয়াজিব। 

সুতরাং ‘শাসকের কথা শুনতে হবে ও তাঁর আনুগত্য করতে হবে যতক্ষণ না (আল্লাহ ও তাঁর রসূলের) অবাধ্যতা হবে।’ আলেম-উলামার ব্যাপারটাও অনুরূপ। (যদি তাঁদেরকে শাসকদের মধ্যে শামিল করা হয়) অর্থাৎ, তাঁদের আনুগত্য এই জন্যই করতে হবে যে, তাঁরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের যাবতীয় বিধি-বিধান বর্ণনা করেন এবং তাঁর দ্বীনের জন্য পথ-প্রদর্শকের কাজ করেন। বুঝা গেল যে, দ্বীনি বিষয়ে এবং দ্বীন সম্পর্কীয় কার্যকলাপে আলেম-উলামা শাসকদের মতই এমন কেন্দ্রীয়-মর্যাদাসম্পন্ন যে, জনসাধারণ তাঁদের প্রতি রুজু করে থাকে। তবে তাঁদের আনুগত্য ততক্ষণ পর্যন্ত করা যাবে, যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁরা জনসাধারণকে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের কথা শুনাবেন। কিন্তু তাদের বিপথগামী (বা কুরআন ও সুন্নাহর বিপরীতগামী) হওয়ার কথা স্পষ্ট হলে তাঁদের আনুগত্য করা যাবে না। বরং এই অবস্থায় তাঁদের আনুগত্য করলে বড় অপরাধ ও গুনাহ হবে। যা আল্লাহ তাআলা এই আয়াতের শেষের আংশে স্পষ্ট করে দিয়েছেন “কোন বিষয়ে যদি তোমরা মতবিরোধ কর তাহলে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে প্রত্যার্পণ করাও”