day of Ashura

মুহাররম ও আশূরাঃ আমাদের জন্য করণীয় ও বর্জনী

আল্লাহ তা‘আলা আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই বারো মাসে বছর নির্ধারণ করেছেন যেমন তিনি বলেনঃ “নিশ্চয় মাসসমূহের গণনা আল্লাহর কাছে বার মাস যেদিন তিনি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্য থেকে চারটি সম্মানিত” [আত-তওবাঃ৩৬]। সেই চারটি মাস হলো-যিলকদ, যিলহজ, মহররম, এবং রজব। [বুখারী: ৩১৯৭; মুসলিম: ১৬৭৯] এই মাস সমূহের মধ্যে প্রথম মাস হলো মুহাররম মাস। মুহাররম মাসের সাথে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা জড়িত আছে। এই মাসে রয়েছে কিছু সুন্নাত ইবাদত। আবার এই মাসকে কেন্দ্র করে সমাজে কিছু কুসংস্কার ও সুন্নাহ বিরোধী আমল প্রচলিত আছে। এই পোস্টে আমরা এই বিষয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।

মুহাররম মাসের ফযীলত

আমরা ইতিপূর্বেই জানতে পেরেছি যে মুহাররম মাস চারটি হারাম মাসের মধ্যে একটি তাই ইসলামী শরী‘আতে মুহাররম মাসের অনেক ফযীলত রয়েছে।

১. এটা হারাম মাসঃ চারটি হারাম তথা সম্মানিত মাসের মধ্যে অন্যতম হ’ল মুহাররম। মহান আল্লাহ বলেন,

إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُورِ عِنْدَ اللهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِي كِتَابِ اللهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ،

‘নিশ্চয়ই আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির প্রথম দিন থেকে আল্লাহর বিধানে মাসসমূহের গণনা হ’ল বারোটি। যার মধ্যে চারটি মাস হ’ল ‘হারাম’ (মহাসম্মানিত)। এটিই হ’ল প্রতিষ্ঠিত বিধান’ [আত-তওবাঃ৩৬]

আবূ বাকর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) বলেন,

الزَّمانُ قَدِ اسْتَدارَ كَهَيْئَتِهِ يَومَ خَلَقَ اللهُ السَّمَواتِ والأرْضَ، السَّنَةُ اثْنا عَشَرَ شَهْرًا، مِنْها أرْبَعَةٌ حُرُمٌ، ثَلاثَةٌ مُتَوالِياتٌ: ذُو القَعْدَةِ وذُو الحِجَّةِ والمُحَرَّمُ، ورَجَبُ مُضَرَ، الذي بيْنَ جُمادى وشَعْبانَ-

‘আল্লাহ যেদিন আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন, সেদিন হ’তে সময় যেভাবে আবর্তিত হচ্ছিল আজও তা সেভাবে আবর্তিত হচ্ছে। বারো মাসে এক বছর। এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। যুল-কা‘দাহ, যুল-হিজ্জাহ ও মুহাররাম। তিনটি মাস পরস্পর রয়েছে। আর একটি মাস হ’ল রজব-ই-মুযার যা জুমাদা ও শা‘বান মাসের মাঝে অবস্থিত’। [বুখারী হা/৩১৯৭; মুসলিম হা/১৬৭৯; আবূদাঊদ হা/১৯৪৭।]

২. এই মাসের ছিয়াম রামাযানের পরে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণঃ  আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

 أفضَلُ الصِّيامِ بعدَ شَهرِ رمَضانَ شهرُ اللهِ المُحرَّمُ، وإنَّ أفضَلَ الصَّلاةِ بعد المفروضةِ صلاةٌ مِن اللَّيْلِ ‘রামাযান মাসের পর আল্লাহর মাস মুহাররমের ছিয়াম হচ্ছে সর্বোত্তম এবং ফরয ছালাতের পর রাতের ছালাতই সর্বোত্তম’। [মুসলিম হা/১১৬৩; আবূদাঊদ হা/২৪২৯।]

৪. এই মাস আল্লাহর মাসঃ বছরের সব মাস আল্লাহর হ’লেও মুহাররমকে আল্লাহ নিজের মাস বলে ঘোষণা দিয়েছেন। “আবূ হুরায়রাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ রমযানের সিয়ামের পর সর্বোত্তম সওম হচ্ছে আল্লাহর মাস মুহাররমের সওম এবং ফারয (ফরয) সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত (সালাত/নামাজ/নামায) হচ্ছে রাতের সালাত।”। [মুসলিম হা/১১৬৩; আবূদাঊদ হা/২৪২৯।]

 

আশূরা কী?

আরবী ‘আশারা (عشر) শব্দ থেকে এসেছে ‘আশূরা (عاشوراء)। ‘আশারা অর্থ দশ আর ‘আশূরা অর্থ দশম, মাসের দশম দিন। হিজরী সনের প্রথম মাস মুহাররমের দশ তারিখকে আশূরা বা আশূরায়ে মুহাররম বলা হয়।

আশূরার করণীয় সমূহ

আশূরাকে কেন্দ্র করে আমাদের সমাজে বিভিন্ন আমলের প্রচলন দেখা যায়। যার সবগুলো ইসলাম সমর্থন করে না। ইসলামের আলোকে আশূরায় করণীয় হ’ল-

১. হারাম মাস হিসাবে এ মাসকে সম্মান করাঃ

যেমন হাদিসে এসেছে, আবূ জামরাহ (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ইবনু ‘আব্বাস (রাযি.)-এর সাথে বসতাম। তিনি আমাকে তাঁর আসনে বসাতেন। একবার তিনি বললেনঃ তুমি আমার কাছে থেকে যাও, আমি তোমাকে আমার ধন-সম্পদ হতে কিয়দংশ প্রদান করব। আমি তাঁর সাথে দুমাস থাকলাম। অতঃপর একদা তিনি বললেন, আবদুল কায়েস-এর একটি প্রতিনিধি দল আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর নিকট আগমন করলে তিনি বললেনঃ তোমরা কোন্ গোত্রের? কিংবা বললেন, কোন্ প্রতিনিধিদলের? তারা বলল, ‘রাবীআ গোত্রের। তিনি বললেনঃ স্বাগতম সে গোত্র বা সে প্রতিনিধি দলের প্রতি, যারা অপদস্থ ও লজ্জিত না হয়েই আগমন করেছে। তারা বলল, হে আল্লাহর রাসূল! শাহরুল হারাম ব্যতীত অন্য কোন সময় আমরা আপনার নিকট আগমন করতে পারি না। আমাদের এবং আপনার মধ্যে মুযার গোত্রীয় কাফিরদের বসবাস। তাই আমাদের কিছু স্পষ্ট নির্দেশ দিন, যাতে করে আমরা যাদের পিছনে ছেড়ে এসেছি তাদের অবগত করতে পারি এবং যাতে করে আমরা জান্নাতে দাখিল হতে পারি। তারা পানীয় সম্বন্ধেও জিজ্ঞেস করল।

তখন তিনি তাদেরকে চারটি বিষয়ের আদেশ এবং চারটি বিষয় হতে নিষেধ করলেন। তাদেরকে এক আল্লাহ্তে বিশ্বাস স্থাপনের নির্দেশ দিয়ে বললেনঃ

এক আল্লাহর প্রতি কীভাবে বিশ্বাস স্থাপন করা হয় তা কি তোমরা অবগত আছ?’ তাঁরা বলল, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই অধিক জ্ঞাত। তিনি বললেনঃ ‘তা হচ্ছে এ সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ্ ব্যতীত প্রকৃত কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করা, যাকাত আদায় করা, রমাযানের সিয়ামব্রত পালন করা; আর তোমরা গানীমাতের সম্পদ হতে এক-পঞ্চমাংশ আদায় করবে। তিনি তাদেরকে চারটি বিষয় হতে বিরত থাকতে বললেন। আর তা হচ্ছেঃ সবুজ কলস, শুকনো কদুর খোল, খেজুর বৃক্ষের গুড়ি হতে তৈরী বাসন এবং আলকাতরা দ্বারা রাঙানো পাত্র। রাবী বলেন, বর্ণনাকারী (মুযাফ্ফাত-এর স্থলে) কখনও আন্নাক্বীর উল্লেখ করেছেন (দুটি শব্দের অর্থ একইরূপ)। তিনি আরো বলেন, তোমরা এ বিষয়গুলো ভালো করে জেনে নাও এবং অন্যদেরও এগুলো অবগত কর। [বুখারী হা/৫৩, ৮৭; মুসলিম হা/১৭; মিশকাত হা/১৭।]

২. ছিয়াম পালন করাঃ এ মাসের অন্যতম কাজ হ’ল এ মাসের দশ তারিখে ছিয়াম পালন করা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মক্কাতে অবস্থান কালে এ ছিয়াম পালন করতেন। মক্কার কুরায়শরাও এই দিনকে সম্মান করত ও ছিয়াম পালন করত। 


আশুরার সিয়ামের গুরুত্ব

১। জাহিলিয়্যাতের যুগেও রসূল সাঃ এই সিয়াম পালন করতেনঃ যেমন হাদিসে এসেছে,আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

كَانَ يَوْمُ عَاشُورَاءَ تَصُومُهُ قُرَيْشٌ فِي الْجَاهِلِيَّةِ وَكَانَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَصُومُهُ فَلَمَّا قَدِمَ الْمَدِينَةَ صَامَهُ وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ فَلَمَّا فُرِضَ رَمَضَانُ تَرَكَ يَوْمَ عَاشُورَاءَ فَمَنْ شَاءَ صَامَهُ وَمَنْ شَاءَ تَرَكَهُ-

জাহিলিয়্যাতের যুগে কুরাইশগণ ‘আশূরার সওম পালন করত এবং আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -ও এ সওম পালন করতেন। যখন তিনি মাদ্বীনায় আগমন করেন তখনও এ সওম পালন করেন এবং তা পালনের নির্দেশ দেন। যখন রমাযানের সওম ফরজ করা হল তখন ‘আশূরার সওম ছেড়ে দেয়া হলো, যার ইচ্ছা সে পালন করবে আর যার ইচ্ছা পালন করবে না। [বুখারী হা/২০০২; মুসলিম হা/১১২৫; আবূদাঊদ হা/২৪৪২।]

২। মদীনায় হিজরতের পরও রাসূল সাঃ এই সিয়াম রাখতেনঃ মদীনায় হিজরতের পর তিনি এ ছিয়াম পালন করতেন ও ছাহাবায়ে কেরামকে ছিয়াম পালনের নির্দেশ দেন। ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

قَدِمَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم الْمَدِينَةَ فَرَأَى الْيَهُودَ تَصُومُ يَوْمَ عَاشُورَاءَ فَقَالَ مَا هَذَا قَالُوا هَذَا يَوْمٌ صَالِحٌ هَذَا يَوْمٌ نَجَّى اللهُ بَنِي إِسْرَائِيلَ مِنْ عَدُوِّهِمْ فَصَامَهُ مُوسَى قَالَ فَأَنَا أَحَقُّ بِمُوسَى مِنْكُمْ فَصَامَهُ وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ-

‘নবী করীম (ছাঃ) মদীনায় আগমন করে দেখতে পেলেন যে, ইহুদীরা আশূরার দিনে ছিয়াম পালন করে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার? (তোমরা এ দিনে ছিয়াম পালন কর কেন?) তারা বলল, এটি অতি উত্তম দিন। এ দিনে আল্লাহ তা‘আলা বনী ইসরাঈলকে তাদের শত্রুর কবল হ’তে নাজাত দান করেছেন। ফলে এ দিনে মূসা (আঃ) ছিয়াম পালন করতেন। রাসূল (ছাঃ) বললেন, আমি তোমাদের অপেক্ষা মূসার অধিক নিকটবর্তী। এরপর তিনি এ দিনে ছিয়াম পালন করেন এবং (লোকদেরকে) ছিয়াম পালনের নির্দেশ দেন’। [ বুখারী হা/২০০৪; মুসলিম হা/১১৩০; ইবনে মাজাহ হা/১৭৩৪।]

৩। রামাযানের ছিয়াম ফরয হওয়ার আগে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুহাররম মাসের দশ তারিখে ছিয়াম পালনে বিশেষ গুরুত্ব দিতেনঃ রাসূল সাঃ এর পাশাপাশি ছাহাবীগণও আশূরার ছিয়াম পালনের ব্যাপারে গুরুত্ব দিতেন। রুবাইয়ি‘ বিনতু মু‘আবিবয (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

أَرْسَلَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم غَدَاةَ عَاشُورَاءَ إِلَى قُرَى الأَنْصَارِ مَنْ أَصْبَحَ مُفْطِرًا فَلْيُتِمَّ بَقِيَّةَ يَوْمِهِ وَمَنْ أَصْبَحَ صَائِمًا فَليَصُمْ قَالَتْ فَكُنَّا نَصُومُهُ بَعْدُ وَنُصَوِّمُ صِبْيَانَنَا وَنَجْعَلُ لَهُمْ اللُّعْبَةَ مِنْ الْعِهْنِ فَإِذَا بَكَى أَحَدُهُمْ عَلَى الطَّعَامِ أَعْطَيْنَاهُ ذَاكَ حَتَّى يَكُونَ عِنْدَ الإِفْطَارِ-

‘আশূরার সকালে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আনছারদের সকল পল্লীতে এ নির্দেশ দিলেন, যে ব্যক্তি ছিয়াম পালন করেনি সে যেন দিনের বাকী অংশ না খেয়ে থাকে। আর যার ছিয়াম অবস্থায় সকাল হয়েছে, সে যেন ছিয়াম পূর্ণ করে। তিনি (রুবাইয়ি‘) (রাঃ) বলেন, পরবর্তীতে আমরা ঐ দিন ছিয়াম পালন করতাম এবং আমাদের শিশুদের ছিয়াম পালন করাতাম। আমরা তাদের জন্য পশমের খেলনা তৈরি করে দিতাম। তাদের কেউ খাবারের জন্য কাঁদলে তাকে ঐ খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে রাখতাম। আর এভাবেই ইফতারের সময় হয়ে যেত’। [বুখারী হা/১৯৬০।] 

অন্য বর্ণনায় এসেছে,

 فَإِذا سَأَلُونا الطَّعامَ، أَعْطَيْناهُمُ اللُّعْبَةَ تُلْهِيهِمْ حتّى يُتِمُّوا صَوْمَهُمْ-

‘যখন তারা আমাদের কাছে খাবার চাইত, আমরা তাদের খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে রাখতাম যতক্ষণ না তারা তাদের ছিয়াম পূর্ণ করত’। [মুসলিম হা/১১৩৬।]

৪। রমজানের সিয়ামের পরেই আশুরার সিয়ামের গুরুত্বঃ

ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-কে ‘আশূরার দিনের ছিয়ামের উপরে অন্য কোন দিনের ছিয়ামকে প্রাধান্য দিতে দেখিনি এবং এ মাস অর্থাৎ রামাযান মাস (এর উপর অন্য মাসের গুরুত্ব প্রদান করতেও দেখিনি)। [বুখারী হা/২০০৬; মুসলিম হা/১১৩২।]

আল-হাকাম ইবনুল আ‘রাজ (রহ.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি ইবনু আববাস (রাঃ)-এর নিকট এলাম। এ সময় তিনি মাসজিদুল হারামে তার চাদরে হেলান দেয়া অবস্থায় ছিলেন। আমি তাকে আশূরার ছিয়াম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, যখন তুমি মুহাররমের নতুন চাঁদ দেখবে, তখন থেকে গণনা করতে থাকবে। এভাবে যখন নবম দিন আসবে তখন ছিয়াম অবস্থায় ভোর করবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, মুহাম্মাদ (ছাঃ) কি এভাবে ছিয়াম রাখতেন? তিনি বলেন, মুহাম্মাদ (ছাঃ) এভাবেই ছিয়াম রাখতেন’। [মুসলিম হা/১১৩৩; তিরমিযী হা/৭৫৪; আহমাদ হা/২২১৪।]

৫। আশুরার সিয়াম এক বছরের গুনাহের কাফফারাঃ

আশূরার ছিয়াম পূর্ববর্তী এক বছরের ছগীরা গুনাহের কাফফারা স্বরূপ। আবু ক্বাতাদাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

 صَوْمُ يَوْمِ عَاشُوْرَاءَ إِنِّي أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ

‘আর আশূরার ছিয়াম, আমি আশা করি (এর বিনিময়) বিগত এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করা হবে’। [মুসলিম হা/১১৬২; আবূদাঊদ হা/২৪২৫।] 

অন্য শব্দে এসেছে, يُكَفِّرُ السَّنَةَ المَاضِيَةَ  ‘বিগত এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করবেন’। [আহমাদ হা/২২০২৪; রিয়াযুছ ছালেহীন হা/১২৬০]

আশূরার ছিয়ামের হুকুম

আশূরার ছিয়াম পালন করা সুন্নাত।

হুমাইদ ইবনু আব্দুর রহমান (রহঃ) থেকে বর্ণিত, যে বছর মু‘আবিয়া (রাঃ) হজ্জ করেন, সে বছর আশূরার দিনে (মসজিদে নববীর) মিম্বরে তিনি (রাবী) তাঁকে বলতে শুনেছেন যে,

 يَا أَهْلَ الْمَدِينَةِ أَيْنَ عُلَمَاؤُكُمْ سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ هَذَا يَوْمُ عَاشُورَاءَ وَلَمْ يَكْتُبْ اللهُ عَلَيْكُمْ صِيَامَهُ وَأَنَا صَائِمٌ فَمَنْ شَاءَ فَلْيَصُمْ وَمَنْ شَاءَ فَلْيُفْطِرْ-

‘হে মদীনাবাসীগণ! তোমাদের আলিমগণ কোথায়? আমি আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, আজকে আশূরার দিন, আল্লাহ তা‘আলা এর ছিয়াম তোমাদের উপর ফরয করেননি বটে, তবে আমি ছিয়াম পালন করছি। যার ইচ্ছা সে ছিয়াম পালন করুক, যার ইচ্ছা সে পালন না করুক’। [বুখারী হা/২০০৩; ইবনু হিববান হা/৩৬২৬।]

আশূরার ছিয়াম কতদিন আদায় করতে হবে

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মক্কায় ও মদীনায় প্রথম দিকে মুহাররম মাসে এক দিন ছিয়াম পালন করতেন। পরবর্তীতে ইহুদীদের বিরোধিতা করার জন্য ৯ তারিখসহ দুই দিন ছিয়াম পালনের আশা প্রকাশ করেন। আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) যখন নিজে আশূরার দিন ছিয়াম রাখলেন এবং আমাদেরকেও এ ছিয়াম পালনের নির্দেশ দেন, তখন লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! ইহুদী ও খৃষ্টানরা এ দিনটিকে সম্মান করে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন,

فَإِذَا كَانَ الْعَامُ الْمُقْبِلُ صُمْنَا يَوْمَ التَّاسِعِ ‏فَلَمْ يَأْتِ الْعَامُ الْمُقْبِلُ حَتَّى تُوُفِّيَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم

‘আগামী বছর আসলে আমরা নবম দিনেও ছিয়াম পালন করব। কিন্তু আগামী বছর না আসতেই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মৃত্যুবরণ করেন’।[মুসলিম হা/১১৩৪; আবূদাঊদ হা/২৪৪৫।] 

ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, صُومُوا التَّاسِعَ وَالْعَاشِرَ وَخَالِفُوا الْيَهُودَ  ‘তোমরা ৯ ও ১০ তারীখে ছিয়াম রাখ এবং ইহুদীদের বৈপরীত্য কর’। [তিরমিযী হা/৭৫৫; বায়হাক্বী হা/৮৬৬৫] 

সুতরাং মুহাররমের দু’টি ছিয়াম পালন করা উত্তম। এক্ষেত্রে দশ তারিখের আগের দিন বা পরের দিন ছিয়াম রাখা যেতে পারে। ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত,

صُوموا يومَ عاشوراءَ وخالِفوا فيه اليهودَ صوموا قبلَهُ يومًا وبعده يومًا

‘তোমরা আশূরার ছিয়াম পালন কর এবং ইহুদীদের বিরোধিতা করা। তোমরা আশূরার আগের দিন অথবা পরের দিন ছিয়াম পালন কর’। [ আহমাদ হা/২১৫৪ ]


অশূরার ইতিহাস

আল্লাহ কর্তৃক ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিসমূহের অন্যতম জাতি হ’ল ফেরাঊনের জাতি। আল্লাহ তাদেরকে হেদায়াতের জন্য মূসা (আঃ) ও তাঁর ভাই হারূন (আঃ)-কে নবী হিসাবে প্রেরণ করেছিলেন। আর আসমানী কিতাব তাওরাত নাযিল করেছিলেন। মূসা (আঃ)-এর জন্মের পূর্ব থেকেই বণী ইসরাঈলের উপর ফেরাউন অত্যাচার করত। সেসময় ফেরাউন নিজেকে ইলাহ দাবী করল এবং মূসা (আঃ)-এর কওমের উপর অত্যাচার আরো বৃদ্ধি করে দিল। ফলে মূসা (আঃ) আল্লাহর আদেশে একরাতে তাঁর অনুসারীদের নিয়ে চলে যাওয়ার সময় সমুদ্র বাধা হয়ে দাঁড়াল। আল্লাহ মূসাকে লাঠি দ্বারা সাগরে আঘাত করার আদেশ দিলে সাগর ভাগ হ’ল এবং প্রত্যেক ভাগ বিশাল পর্বতের মত হয়ে গেল’ (শু‘আরা আয়াতঃ ৬৩)। সাগর পাড়ি দেওয়ার সময় ফেরাঊন তাদের পিছনে ধাওয়া করল। আল্লাহ মূসা ও তাঁর জাতিকে আল্লাহ রক্ষা করলেন আর ফেরাঊন ও তার জাতিকে পানিতে নিমজ্জিত করে ধ্বংস করলেন (বাক্বারাহ আয়াতঃ ৫০)। আল্লাহ বলেন,

وَجَاوَزْنَا بِبَنِي إِسْرَائِيلَ الْبَحْرَ فَأَتْبَعَهُمْ فِرْعَوْنُ وَجُنُودُهُ بَغْيًا وَعَدْوًا حَتَّى إِذَا أَدْرَكَهُ الْغَرَقُ قَالَ آمَنْتُ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا الَّذِي آمَنَتْ بِهِ بَنُو إِسْرَائِيلَ وَأَنَا مِنَ الْمُسْلِمِينَ، آلْآنَ وَقَدْ عَصَيْتَ قَبْلُ وَكُنْتَ مِنَ الْمُفْسِدِينَ-

‘আর আমরা বনু ইস্রাঈলকে সাগর পার করে দিলাম। তারপর তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল ফেরাঊন ও তার সেনাবাহিনী হঠকারিতা ও বাড়াবাড়ি বশে। অতঃপর যখন সে ডুবতে লাগল তখন বলে উঠল, আমি ঈমান আনলাম এই মর্মে যে, কোন উপাস্য নেই তিনি ব্যতীত যার উপরে বনু ইস্রাঈলগণ ঈমান এনেছে। আর আমি তাঁর প্রতি আত্মসমর্পণকারীদের অন্তর্ভুক্ত। (আল্লাহ বললেন) এখন? অথচ ইতিপূর্বে তুমি অবাধ্যতা করেছিলে এবং ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে’ (ইউনুস আয়াতঃ ৯০-৯১)।

আর এই মহান দিনটি ছিল মুহাররম মাসের দশ তারিখ তথা আশূরার দিন। ইহুদীরা এই দিনকে সম্মান করত ও গুরুত্ব দিত।

আবূ মূসা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

 كَانَ يَوْمُ عَاشُورَاءَ تَعُدُّهُ الْيَهُودُ عِيدًا قَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم فَصُومُوهُ أَنْتُمْ

‘আশূরার দিনকে ইহুদীগণ ঈদ (উৎসবের দিন) মনে করত। নবী করীম (ছাঃ) (ছাহাবীগণকে) বললেন, তোমরাও এ দিনের ছিয়াম পালন কর’। [বুখারী হা/২০০৫; মুসলিম হা/১১৩১] 

আবূ মূসা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

 كانَ أَهْلُ خَيْبَرَ يَصُومُونَ يَومَ عاشُوراءَ، يَتَّخِذُونَهُ عِيدًا وَيُلْبِسُونَ نِساءَهُمْ فيه حُلِيَّهُمْ وَشارَتَهُمْ، فَقالَ رَسولُ اللهِ : فَصُومُوهُ أَنْتُمْ.

‘খায়বারের ইহুদীরা আশূরার দিন ছিয়াম পালন করত। তারা এ দিনকে ঈদরূপে বরণ করত এবং তারা তাদের মহিলাদেরকে অলংকার ও উত্তম পোষাকে সুসজ্জিত করত। এরপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তোমরাও এ দিনে ছিয়াম পালন কর’। [মুসলিম হা/২৫৫১]


আশূরা সম্পর্কিত দুর্বল ও মিথ্যা বর্ণনা সমূহ

১. আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ وَسَّعَ عَلى عِيَالِه فِي النَّفَقَةِ يَوْمَ عَاشُورَاءَ وَسَّعَ اللهُ عَلَيْهِ سَائِرَ سَنَتِه. قَالَ سُفْيَانُ: إِنَّا قَدْ جَرَبْنَاهُ فَوَجَدْنَاهُ كَذلِكَ ‘যে ব্যক্তি আশূরার দিন নিজের পরিবার-পরিজনের জন্য উদার হস্তে খরচ করবে আল্লাহ তা‘আলা সারা বছর উদারহস্তে তাকে দান করবেন। সুফিয়ান ছাওরী বলেন, আমরা এর পরীক্ষা করেছি এবং কথার সত্যতার প্রমাণ পেয়েছি’। [হাদীছটি যঈফ]

২. ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, مَنِ اكتحلَ يومَ عاشوراءَ بالإثمدِ لمْ ترمدْ عيناهُ أبدًا، ‘যে ব্যক্তি আশূরার দিবসে ইছমিদ নামক পাথরের সুরমা ব্যবহার করবে, সে কখনও ঝাপসা দেখবে না’। [হাদীছটি জাল]

৩. আরেকটি বর্ণনা,

 منِ اغتسلَ يومَ عاشوراءَ لم يَمرضْ ذلك العامَ، ومن اكتحلِ يومَ عاشوراءَ لم يَرمدْ ذلك العامَ

‘যে ব্যক্তি আশূরার দিন গোসল করবে সে এই বছর রোগাক্রান্ত হবে না। আর যে ব্যক্তি আশূরার দিন চোখে সুরমা লাগাবে তার এই বছর চোখের কোন রোগ হবে না’।  [হাদীছটি জাল]

ইবনু তায়মিয়া (রঃ) বলেন, আমাদের কোন আলেম আশূরার দিন গোসল করাকে পসন্দ করতেন না এবং চোখেও সুরমা লাগাতেন না।... আর রাসূল (ছাঃ)ও এরূপ করেননি। এরূপ করেননি আবু বকর, ওমর, ওছমান ও আলী (রাঃ)ও। [মাজমূউল ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া ৪/৫১৩-৫১৪।]

৪. আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত,

 عاشوراءُ عيدُ نبيٍّ كانَ قبلَكم فصوموهُ أنتمْ

‘আশূরা হ’ল তোমাদের পূর্ববর্তী নবীদের ঈদের দিন। সুতরাং তোমরা এই দিন ছিয়াম পালন কর’। [আলবানী হাদীছটিকে যঈফ বলেছেন]

৫. আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত,

من صام يومَ عاشوراءَ كتب اللهُ له عبادةَ سبعين سنةً بصيامِها وقيامِها من صام يومَ عاشوراء أُعطِيَ ثوابَ عشرةِ آلافِ ملَكٍ ومن صام يومَ عاشوراءَ أُعطِيَ ثوابَ حاجٍّ ومُعتمرٍ-

‘যে আশূরার দিন ছিয়াম পালন করবে আল্লাহ তার জন্য সত্তর বছরের ছিয়াম ও ক্বিয়ামের নেকী লিখে দিবেন। যে আশূরার দিন ছিয়াম পালন করবে তার জন্য দশ হাযার ফেরেশতার সমান ছওয়াব দেওয়া হবে। আর যে আশূরার দিন ছিয়াম পালন করবে তাকে হজ্জ ও ওমরার ছওয়াব দেওয়া হবে’। [ইবনুল ক্বাইয়িম এটাকে জাল বলেছেন]


আশূরা কেন্দ্রিক শরী‘আত বিরোধী কিছু কাজ

১. হুসাইন (রাঃ)-এর মৃত্যুবার্ষিকী পালনঃ  কোন মুসলিম ব্যক্তি মারা গেলে তার মৃত্যুর খবরে ‘ইন্না লিল্লা-হি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজে‘ঊন’ পাঠ করে তার জন্য দো‘আ করা, তার জানাযাহ ও দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করা অন্য মুসলিমের ঈমানী দায়িত্ব। আর তার মৃত্যুতে সর্বোচ্চ তিন দিন শোক পালন করা যাবে। যদিও তারা পিতা-মাতা, ছেলে-মেয়ে হয়। তবে স্ত্রী স্বামীর জন্য চার মাস দশ দিন শোক পালন করবেন এবং বিবাহ, সাজগোজ থেকে বিরত থাকবেন’ (বাক্বারাহ আয়াতঃ ২৩৪)।

যায়নাব বিনতু আবূ সালামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন সিরিয়া হ’তে আবূ সুফিয়ান (রাঃ)-এর মৃত্যুর খবর পৌঁছালো, তার তৃতীয় দিবসে উম্মু হাবীবা (রাঃ) হলুদ বর্ণের সুগন্ধি আনয়ন করলেন এবং তাঁর উভয় গন্ড ও বাহুতে মাখলেন। অতঃপর বললেন, অবশ্য আমার এর কোন প্রয়োজন ছিল না, যদি আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে এ কথা বলতে না শুনতাম যে,

 لاَ يَحِلُّ لاِمْرَأَةٍ تُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ أَنْ تُحِدَّ عَلَى مَيِّتٍ فَوْقَ ثَلاَثٍ، إِلاَّ عَلَى زَوْجٍ، فَإِنَّهَا تُحِدُّ عَلَيْهِ أَرْبَعَةَ أَشْهُرٍ وَعَشْرًا،

‘যে স্ত্রীলোক আল্লাহ এবং ক্বিয়ামাত দিবসের প্রতি ঈমান রাখে তার পক্ষে স্বামী ব্যতীত অন্য কোন মৃত ব্যক্তির জন্য তিন দিনের বেশী শোক পালন করা বৈধ নয়। অবশ্য স্বামীর জন্য সে চার মাস দশ দিন শোক পালন করবে’। [বুখারী হা/১২৮০, মুসলিম হা/১৪৮৬।]

কোন মুসলমান মৃত্যুবরণ বা শাহাদতবরণ করলে তার জন্য মৃত্যুবার্ষিকী পালনের বিধান ইসলামে নেই। রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম কখনো কারো জন্ম বা মৃত্যুবার্ষিকী পালন করেননি। হোসাইন (রাঃ)-এর শাহাদত বরণের মর্মান্তিক ঘটনাটিও আশূরার দিনে অর্থাৎ ১০ই মুহাররম ঘটেছিল। যা মুসলমানদের জন্য নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। কিন্তু এর জন্য সেদিন শোক দিবস হিসাবে পালন করা শরী‘আত সম্মত নয়।

আববাসীয় খলীফা মুত্বী‘ বিন মুকতাদিরের সময়ে (৩৩৪-৩৬৩ হিঃ/৯৪৬-৯৭৪ খৃ.) তার শক্তিশালী শী‘আ আমীর মু‘ইযযুদ্দৌলা হুসায়েন (রাঃ)-এর শাহাদতের স্মরণে ৩৫২ হিজরীর ১০ই মুহাররমকে ‘শোক দিবস’ ঘোষণা করেন এবং সকল দোকান-পাট, ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত বন্ধ করে দেন। তিনি মহিলাদের শোকে চুল ছিঁড়তে, চেহারা কালো করতে, রাস্তায় নেমে শোকগাথা গেয়ে চলতে বাধ্য করেন। শহরে ও গ্রামে সর্বত্র সকলকে শোক মিছিলে যোগদান করতে নির্দেশ দেন। শী‘আরা খুশী মনে এই নির্দেশ পালন করে। কিন্তু সুন্নীরা চুপ হয়ে যান। পরে সুন্নীদের উপরে এই ফরমান জারী হ’লে ৩৫৩ হিজরীতে উভয় দলে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। ফলে বাগদাদে তীব্র নাগরিক অসন্তোষ ও সামাজিক বিশৃংখলা ছড়িয়ে পড়ে।

৩. মাতম করাঃ আশূরার দিনকে কেন্দ্র করে অনেকে ‘হায় হোসেন’ ‘হায় হোসেন’ বলে বিলাপ করেন, বুক চাপড়ান ও মাথায় কালো কাপড় বেঁধে শোক প্রকাশ করেন, যা সম্পূর্ণভাবে হারাম ও কবীরা গুনাহ। সকল আলেম একমত যে, আওয়াজ করে মৃত ব্যক্তির জন্য কান্নাকাটি করা জায়েয নয়। 

আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘মানুষের মধ্যে দু’টো আচরণ এমন পাওয়া যায়, যা তাদের ক্ষেত্রে কুফরীমূলক কর্ম; বংশে খোঁটা দেওয়া ও মৃতের জন্য মাতম করে কান্না করা’। 

আবূ বুরদাহ, ইবনু আবূ মূসা (রহঃ) থেকে বর্ণিত, একবার আমার পিতা আবূ মূসা অজ্ঞান হয়ে গেলেন। এতে (আমার বিমাতা) তাঁর স্ত্রী আব্দুল্লাহর মা বিলাপ করতে লাগল। অতঃপর তিনি সংজ্ঞা লাভ করলেন এবং আব্দুল্লাহর মাকে বললেন, তুমি কি জানো না? তারপর তিনি একটি হাদীছ বর্ণনা করলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, أَنَا بَرِىْءٌ مِمَّنْ حَلَقَ وَصَلَقَ وَخَرَقَ  ‘আমি তার সাথে সম্পর্কহীন যে মাথার চুল ছিঁড়ে, উচ্চৈঃস্বরে বিলাপ করে এবং জামার গলা ফাঁড়ে’। [মুসলিম হা/১০৪; নাসাঈ হা/১৮৬৩; ইবনু মাজাহ হা/১৫৮৬; মিশকাত হা/১৭২৬।]

৪. মর্ছিয়া করাঃ মর্ছিয়া (المرثية) আরবী শব্দ। এর অর্থ- শোকগাথা, শোকসঙ্গীত। আমাদের সমাজে কারবালার ইতিহাসকে নিয়ে বিভিন্ন রকম কবিতা, জারী গান, বিভিন্ন নভেল-নাটক ও গল্প-উপন্যাস লেখা হয়েছে। যার অধিকাংশ ভিত্তিহীন ও মনগড়া। যেখানে ইয়াযীদ ও তার পিতা বিশিষ্ট ছাহাবী মু‘আবিয়া বিন আবু সুফিয়ান (রাঃ)-কে হেয় করা হয়েছে। মীর মোশাররফ হোসেন কর্তৃক রচিত ‘বিষাদ সিন্ধু’কে কারবালার ইতিহাস গ্রন্থ মনে করা হয়। অথচ এই উপন্যাসের অধিকাংশ তথ্যই মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। ইসলামে মৃত ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে এসকল কার্যকলাপ কখনো জায়েয নয়।

৫. তা‘যিয়া (الةعزية) করাঃ তা‘যিয়া শব্দের অর্থ- সান্তবনা দান, শোক প্রকাশ। আশূরার দিন হুসায়েন (রাঃ)-এর কাল্পনিক কবর তৈরী করে তা‘যিয়া বা শোক মিছিল করা হয়। ঐ ভুয়া কবরগুলিকে ‘আত্মা সমূহের অবতরণস্থল’ বলে ধারণা করা হয়। সেখানে হুসায়েনের রূহ হাযির হয় কল্পনা করে তাকে সালাম দেওয়া হয়। তার সামনে মাথা ঝুঁকানো হয়। সেখানে সিজদা করা হয়, মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্য প্রার্থনা করা হয়। এগুলো স্পষ্ট শিরক। তা‘যিয়া-মাতম বর্জন করে তাদের জন্য দো‘আ করা উচিত।

৬. নিজের উপর আঘাত করা ও কাপড় ছেঁড়াঃ  অশূরার দিন অনেকে হুসাইন (রাঃ)-এর মৃত্যুকে স্মরণ করে, তার শোকে বিভিন্ন ধারালো জিনিস দিয়ে নিজের দেহকে আঘাত করে রক্তাক্ত করে এবং নিজের গায়ের কাপড় ছিঁড়ে ফেলে। এটা ইসলাম সমর্থন করে না।

আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) ইরশাদ করেছেন, لَيْسَ مِنَّا مَنْ ضَرَبَ الْخُدُودَ وَشَقَّ الْجُيُوبَ وَدَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ

‘যারা শোকে মুখে চপেটাঘাত করে, জামা ছিন্ন করে ও জাহিলী যুগের মত চিৎকার করে, তারা আমাদের দলভুক্ত নয়’। [বুখারী হা/১২৯৭]

 হুসাইন (রাঃ)-এর বড় ভাই হাসান (রাঃ) নিহত হয়েছিলেন, তার পিতা আলী ইবনে আবু তালিব শাহাদত বরণ করেছেন। ইসলামের ইতিহাসে এরকম অনেক দুঃখজন ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু মুসলমানরা কারো জন্যই এ রকম শোক পালন করেন না।

৭. ছাহাবী-তাবেঈদেরকে মন্দ বলাঃ আশূরার দিন হাসান-হোসাইন (রাঃ)-কে মর্যাদা দিতে গিয়ে অনেকে কোন কোন ছাহাবী-তাবেঈ সম্পর্কে মন্দ ধারণা করে থাকেন। এমনকি গালিও দিয়ে থাকেন। আয়েশা (রাঃ)-এর নামে একটি বকরী বেঁধে রেখে লাঠিপেটা ও অস্ত্রাঘাতে রক্তাক্ত করা হয়। এছাড়াও মু‘আবিয়া (রাঃ) ও তাঁর ছেলে ইয়াযীদকে কারবালার ঘটনার জন্য দায়ী করে গালি-গালাজ করে থাকেন। অথচ ছাহাবীগণকে গালি দেওয়া বড় গুনাহের কাজ।

আবূ সা‘ঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,

 لَا تَسُبُّوْا أَصْحَابِيْ فَلَوْ أَنَّ أَحَدَكُمْ أَنْفَقَ مِثْلَ أُحُدٍ ذَهَبًا مَا بَلَغَ مُدَّ أَحَدِهِمْ وَلَا نَصِيْفَهُ تَابَعَهُ  

‘তোমরা আমার ছাহাবীগণকে গালমন্দ কর না। তোমাদের কেউ যদি ওহোদ পর্বত পরিমাণ সোনা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় কর, তবুও তাদের এক মুদ বা অর্ধ মুদ-এর সমপরিমাণ ছওয়াব লাভ করতে পারবে না’। [বুখারী হা/৩৬৭৩, মুসলিম হা/২৫৪০।]

৮. বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালন করাঃ  আশূরার নামে বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালন করা হয়। যেমন- সরকারী ছুটির ব্যবস্থা করা, রাস্তা-ঘাট বিভিন্ন রঙে সাজানো, লাঠি, তীর, বল্লম নিয়ে যুদ্ধের মহড়া দেওয়া, হুসাইন (আঃ)-এর নামে কেক ও পাউরুটি বানিয়ে ‘বরকতের পিঠা’ বলে বিক্রি করা ইত্যাদি। এসব অনুষ্ঠান পালনে অনেক টাকার অপচয় হয়, সময় নষ্ট হয় আর ইসলামের নিষেধাজ্ঞা তো আছেই। অপরদিকে অনেকে এই মাসকে শোকের মাস ভেবে বিবাহ-শাদী করা, আশূরার দিনে পানি পান করা ও শিশুদেরকে দুধ পান করানোকেও অন্যায় মনে করেন।

৯. কারবালার ঘটনাকে হক ও বাতিলের লড়াই মনে করাঃ  কারবালার ঘটনাকে অনেকে হক ও বাতিলের লড়াই বলে আখ্যায়িত করেন। তারা হুসাইনকে হক ও ইয়াযীদকে বাতিল বলে মনে করেন। এই বিশ্বাস ঠিক নয়। বিষয়টি ছিল ইজতিহাদী বিষয়, হক বাতিলের বিষয় ছিল না। কারণ হুসাইন (রাঃ)-কে হকপন্থী বলে মনে করলেও ইয়াযীদকে বাতিল বলা যাবে না। ইয়াযীদ মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর যোগ্য সন্তান ছিলেন এবং মু‘আবিয়ার পরে তাকে খলীফা বানানোর জন্য সকল গভর্নর পরামর্শ দিয়েছিলেন। তৎকালে জীবিত ৬০ জন ছাহাবী ও ইসলামী বিশে^র নেতৃবৃন্দের প্রায় সবাই মেনে নিয়েছিলেন ও বায়‘আত করেছিলেন। হুসাইন (রাঃ) নিহত হওয়ার পরও তার বিরুদ্ধে কোনরূপ আন্দোলন গড়ে তোলেননি। আর তিনি প্রায় চার বছর (৬০-৬৪ হিঃ) মুসলিম সম্রাজ্যের শাসক ছিলেন। প্রথম দিকে কেবলমাত্র মদীনায় চারজন ছাহাবী বায়‘আত নিতে বাকী ছিলেন। আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর, আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস, আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়ের ও হুসায়েন ইবনু আলী (রাঃ)। প্রথমোক্ত দু’জন পরে বায়‘আত করেন। শেষোক্ত দু’জন গড়িমসি করলে আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) তাঁদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন, إتقيا الله ولاتفرقا بين جماعة المسلميبن، ‘আপনারা আল্লাহকে ভয় করুন! মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করবেন না’।

হুসায়েন (রাঃ) কূফায় যাওয়ার অন্যতম কারণ ছিল কূফাবাসীর আগ্রহ ও তাঁর হাতে বায়‘আত করার জন্য লিখিত পত্র।

১০. হুসাইনের মাথা ছয়টি দেশে প্রেরিত হয়েছে বলে বিশ্বাস করাঃ শী‘আদের ওয়েবসাইটের তথ্য মতে বর্তমানে হুসায়েনের মাথা ছয়টি দেশে পূজিত হচ্ছে। ১. মদীনার বাক্বী‘ গোরস্থানে তাঁর মা ফাতেমা (রাঃ)-এর কবরের পাশে ২. দামেষ্কে হুসায়েনের মাথা বা মাসজিদুর রা’স সংলগ্ন গোরস্থানে ৩. মিসরের রাজধানী কায়রোতে। যা ‘তাজুল হুসায়েন’ বা হুসায়েনের মুকুট নামে খ্যাত। এজন্য মিসরীয়রা নিজেদের দেশকে ‘আল্লাহর পসন্দনীয় দেশ’ বা Choosen country বলে গর্ববোধ করে। ৪. ইরানের মারভে। ৫. ইরাকের নাজাফে এবং ৬. কারবালা প্রান্তরে। কিন্তু এসব তথ্যগুলিতে কেউ একমত নন। 

পরিশেষে বলব, আশূরার সঠিক ইতিহাস এবং আশূরার শরী‘আত সম্মত করণীয় সমূহ পালন করতে হবে। আর এ সম্পর্কিত সকল বিদ‘আত পরিত্যাগ করতে হবে। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন!